সরওয়ার ফারুকী : কানাইঘাটের যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হচ্ছে গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক। কানাইঘাট সদর থেকে জেলা সদরের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী এ সড়ক কানাইঘাটের ঠিক মাঝ-বরাবর ছুটে সিলেট সদরের সাথে মিলেছে। পাকিস্তান শাসনামলে প্রস্তাবিত এ সড়ক স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও কানাইঘাটের গলার কাঁটা। নদীমাতৃক এ দেশের যোগাযোগব্যবস্থা এখন আর নদীভিত্তিক নয়, বৈশ্বিক, বাণিজ্যিক এবং রাজনৈতিক কারণে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা এখন নদী ছেড়ে পিচঢালা পথে ওঠেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই আধুনিকায়নের মাঝেও কানাইঘাটের যাতায়াতব্যবস্থার প্রধানতম সড়কটি সংস্কারের অভাবে প্রায় ধ্বংস, চলাচলের অনুপযুক্ত। তবুও জনগণের হাতে বিকল্প না থাকায় তারা মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনে চড়ছেন এবং নিয়মিত দুর্ঘটনায় পড়ছেন। এতে বয়োবৃদ্ধ এবং সন্তানসম্ভবা নারীদের জন্য রাস্তাটি হয়ে ওঠেছে সাক্ষাৎ এক মৃত্যুফাঁদ। রাস্তার খানাখন্দে পড়ে কেউ মেরুদণ্ড ভাঙছেন, কারও বা হচ্ছে গর্ভপাত। স্থানীয় হাসপাতালে পৌঁছার আগেই অনেকে ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর কোলে। এছাড়াও ধুলাবালির দাপটে সকল বয়সের মানুষ শ্বাসকষ্ট, কাশি কিংবা চোখের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, ধুলোবালির ঝাপটায় কানাইঘাটের অধিকাংশ মানুষই এখন নানান রোগের রোগী। পাশাপাশি খানাখন্দের আঘাতে সকলপ্রকার বাহন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, প্রতিদিন গাড়িতে মেরামতের জন্য আলাদা খরচ হচ্ছে— স্বাভাবিকভাবে এই টাকা আদায় হচ্ছে সাধারণ যাত্রীর পকেট থেকে, এতে মাত্র আট কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে গুণতে হচ্ছে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। মাত্রাতিরিক্ত এ ভাড়া সাধারণ জনতার কাছে জুলুমের নামান্তর।
গাজী বোরহান উদ্দিন সড়কের এই দুরবস্থার জন্য প্রধানত দায়ী বিগত পনেরো বছরের জবরদখলকারী শসনব্যবস্থা এবং অথর্ব, অপদার্থ, সুদখোর সাবেক অবৈধ এমপি হাফিজ আহমদ মজুমদার। এই সুদখোর প্রচণ্ড কানাইঘাট বিদ্বেষী। সে কানাইঘাটের উন্নয়নের বিপরীতে সকল প্রকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে মাথা খাটাতো বেশি। ৯৮ সালে গাছবাড়ি বাজারে তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর উপস্থিতিতে কানাইঘাটবাসী গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক ও বিদ্যুতের দাবি জানান, পরবর্তীতে স্থানীয় সংসদ সদস্য হিসেবে হাফিজ আহমদ মজুমদার সংসদে দাঁড়িয়ে কেবল সড়কের দাবী উত্থাপন করেন এবং বিদ্যুতের দাবী গোপন রাখেন। কিন্তু সিলেট-প্রেমী হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী মজুমদারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, সেদিন জনগণ শুধু সড়কের দাবী করেনি, বরং তারা বিদ্যুৎ সহ সড়কের দাবী করছিল। একইভাবে কানাইঘাট বিদ্বেষী এই সংসদ সদস্য কানাইঘাট সদরে সুরমা নদীর দু পাড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দাবীকে দমিয়ে দিতে ৯৯ সালে হঠাৎ নিয়ে আসে একটি ফেরি, ফেরিঘাট না বানিয়ে দারুল উলুম মাদ্রাসার সামনেই সুরমার পানিতে ভাঙা ফেরি ভাসিয়ে কানাইঘাটবাসীর সাথে নির্লজ্জ প্রতারণা করে, এই প্রতারণা কানাইঘাটের আমজনতাকে প্রচণ্ডভাবে বিক্ষুব্ধ করে। কানাইঘাট বিদ্বেষী এই সুদি মহাজন মানুষের সাথে যোগাযোগের বিপরীতে কিছু ইতর পালতো, এরা জন-আকাঙ্খার বিপরীতে মাফিয়াতান্ত্রিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠী গড়ে তোলে এবং জন-আকাঙ্খাকে ধুলোয় মিশিয়ে আপন আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকে। ফলশ্রুতিতে আজ কানাইঘাটের যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে এবং মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ।
পাকিস্তান আমলে প্রস্তাবিত গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক যান চলাচলের উপযোগী হয় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব আবুল হারিস চৌধুরী ও জননন্দিত এমপি ফরিদ উদ্দীন চৌধুরীর যৌথ প্রচেষ্টায় মাটি কাটার অসম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করে প্রাথমিকভাবে ইট সলিংয়ের মাধ্যমে যান চলাচলের উপযোগী করা হয় এবং পরবর্তীতে ধাপেধাপে তা পীচ পথে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু বিগত সরকারের অথর্ব এমপি হাফিজ মজুমদারের রোষানলে এ সড়কের প্রয়োজনীয় সংস্কার বন্ধ হয় এবং দিনেদিনে এ সড়ক মরে যায়, বর্তমানে এ সড়ক মরণফাঁদ হিসেবে কানাইঘাটবাসীর উপর আপতিত হয়েছে।
এই রাস্তার নামকরণ হয় সিলেটের প্রথম মুসলমান হিসেবে খ্যাত, বিখ্যাত সুফি হজরত গাজী বোরহান উদ্দিন-এর নামে। এ নামের সাথে সিলেটবাসীর আবেগ এবং ইতিহাস জড়িত। গৌড়গোবিন্দের শাসন অবসানের সম্পর্ক রয়েছে এ নামের সাথে, তাই এ নামটি ব্রাহ্মণ্যবাদীরা সহ্য করতে পারে না। বিগত পঞ্চাশ বছর এ দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য চরমভাবে দাপট দেখিয়েছে, এ দেশে ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির সকল চিহ্ন তারা ভেঙেছে, নাহয় বিকলাঙ্গ করেছে। গাজী বোরহান উদ্দিনের স্মরণে এ সড়কের নাম রাখায় প্রশাসনের প্রতিটি ধাপে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করেছে এবং এ কাজে হাফিজ আহমদ মজুমদারের মতো লুটেরা, সুদখোরদের ব্যবহার করেছে। এ সড়কের নাম যদি গাজী বোরহান উদ্দিন না হয়ে আধিপত্যবাদী কারও নামে রাখা হতো, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কের এমন বেহাল দশা হতো না, বরং এর উত্তরোত্তর উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার অব্যাহত থাকতো। দ্বিতীয় স্বাধীনতা-পরবর্তী নতুন এই বাংলাদেশে গাজী বোরহান উদ্দিন-এর নামে উৎসর্গীত, জনগুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তার জরুরি সংস্কারের জোর দাবী জানাচ্ছি— যাতে এ অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ-দুর্দশা লাঘব হয়।