তড়িঘড়ি নির্বাচনের চেয়ে টেকসই সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে নির্বাচন কয়েক মাস পেছালেও ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হবে। নির্বাচন কবে– প্রশ্ন সরকারের মনেও সারাক্ষণ রয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই গঠন হবে নির্বাচন কমিশন। তাদের ওপর বর্তাবে নির্বাচনের দায়িত্ব।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে গতকাল রোববার জাতির উদ্দেশে ৩৪ মিনিটের ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা স্পষ্ট করেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে সংকটে পড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তিনি ঘোষণা করেন, শুধু জুলাই গণহত্যা নয়, বিচার হবে গত সাড়ে ১৫ বছরের সব অপকর্মের। আন্তর্জাতিক আদালতেও হবে গণহত্যার বিচার। ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে।
হাজার প্রাণের বিনিময়ে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়। ইস্তফা দিয়ে ভারতে পালান শেখ হাসিনা। এর তিন দিন পর গঠিত সরকার রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করে।
রাজনৈতিক ঐকমত্যে সংস্কার, পরে ভোট
বিএনপিসহ যেসব রাজনৈতিক দল অভ্যুত্থানে সর্বাত্মক অংশ নিয়েছিল, এর অধিকাংশই দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ দিলেও ড. ইউনূস সরকারের মেয়াদ এবং নির্বাচনের সময় স্পষ্ট করেননি। তিনি সংস্কারে জোর দিয়ে বলেন, ‘আমরা দুদিন পরে চলে যাব। কিন্তু আমাদের মাধ্যমে জাতির জন্য যে ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হলো, তা যেন কোনো রকমেই হাতছাড়া করে না দিই।’
সরকারপ্রধান বলেন, নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। এটা আর থামবে না। কিন্তু যেতে যেতে অনেকগুলো কাজ সারতে হবে। ট্রেন শেষ স্টেশনে কখন পৌঁছাবে, তা নির্ভর করবে কত তাড়াতাড়ি রেললাইনগুলো বসিয়ে দিতে পারি, আর তা হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যে।
টেকসই নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলায় জোর দিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে গঠিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর আমাদের প্রধান কাজ। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। তাদের মতামত নিয়ে যাচ্ছি। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যেই সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশ পেশ করতে পারবে। সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসব। সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করব।
সংস্কার কমিশনগুলোতে মতামত জানাতে জনগণের প্রতি আহ্বান রেখেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘আপনি দেশের মালিক। আপনি বলে দিন কী চান, কীভাবে চান। নির্বাচন নিয়ে সব বক্তব্য বিনা দ্বিধায় বলতে থাকুন। অনুরোধ সংস্কারের কথাটাও একই সঙ্গে বলুন। সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে যাবেন না। সংস্কার হলো জাতির দীর্ঘমেয়াদি জীবনীশক্তি। জাতিকে বঞ্চিত করবেন না।’
সংবিধান সংস্কারে রাজনৈতিক দল এবং সব মানুষের মতামত অপরিহার্য বলে অভিমত প্রধান উপদেষ্টার। তিনি বলেন, ‘নিশ্চিত নই, সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের সুযোগ কতটুকু পাব। তবে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। ততদিন ধৈর্য ধারণের অনুরোধ করব। ঐকমত্য গঠনে, সংস্কারের জন্য নির্বাচনকে কয়েক মাস বিলম্বও করা যেতে পারে।’
বিচার হবে সব অপকর্মের
অভ্যুত্থানের শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত দেশ সবাইকে মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে। স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছিল। অভ্যুত্থানে দেড় হাজার ছাত্র, শ্রমিক, জনতা শহীদ হয়েছেন। প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য যত্নের সঙ্গে জোগাড় করছে সরকার। আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ৯৩১ জন। প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। গণহত্যার বিচারকাজ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
ড. ইউনূস জানান, আওয়ামী লীগ আমলে গুমের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তিনি বলেন, দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই। অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক, ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। গুম, গণহত্যায় জড়িতদের আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।
অভ্যুত্থানের শহীদদের পরিবারকে ৩০ লাখ করে টাকা ও পুনর্বাসন এবং আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সরকারের অঙ্গীকার বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে ৫০ লাখ ডলার চাওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ
৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের ভূমিকার জন্য ড. ইউনূস রাজনৈতিক নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তারা কর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সবাই এতে সাড়া দিয়েছেন। ফ্যাসিবাদী শক্তি ভয় দেখিয়েছিল ক্ষমতা ছাড়লে দেশে লাখ লাখ লোক মারা পড়বে। টানা সাত দিন পুলিশ প্রশাসন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় থাকার পরও ব্যাপক আকারে সহিংসতা এড়ানো গেছে।
সংখ্যালঘু নিপীড়নের তথ্যকে অতিরঞ্জিত বলেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে তারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। কিন্তু যেসব প্রচার-প্রচারণা হয়েছে তা ছিল অতিরঞ্জিত। অল্প যেসব সহিংসতা হয়েছে, এর মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক।
অর্থনীতিতে জোর
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গুরুত্ব পেয়েছে দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি। তিনি বলেন, বন্যায় ফসলহানি হয়েছে, ব্যাহত হয়েছে পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল। এতে শাকসবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। আপনাদের কষ্ট হয়েছে। দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। দ্রব্যমূল্য নিয়ে আমাদের কোনো লুকোছাপা নেই। মূল্যস্ফীতির পূর্ণ তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে।
ড. ইউনূস বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল তলানিতে। গত তিন মাসে রিজার্ভে হাত না দিয়েই প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ শোধ করা হয়েছে। জ্বালানি আমদানির বকেয়া ৪৭৮ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে হয়েছে ১৬০ মিলিয়ন। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান হিসেবে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। পতিত সরকার ও তার দোসররা প্রতিবছর দেশ থেকে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। তা ফিরিয়ে আনার জন্য সম্ভব সব ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পরাজিত শক্তিকে নিরাশ করুন
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পরাজিত শক্তি নানা চেহারা নিয়ে আপনাদের প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করছে। পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন, দেশকে মুক্ত রাখুন। এ ব্যাপারে অনড় থাকুন। এমন কিছু করবেন না, যা তাদের উৎসাহিত করতে সাহায্য করে। তাদের সব দিক থেকে নিরাশ করুন। নিশ্চয়তা দিচ্ছি, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মজবুত অর্থনীতি দিয়ে যাব, ভবিষ্যতে চলার পথকে সহজগম্য করে যাব, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে যাব। বিপক্ষ শক্তি যত শক্তিশালীই হোক, নাশকতার যত রকম উদ্ভট পরিকল্পনাই করুক– সব কিছু নস্যাৎ করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
দাবি জানাতে হবে সঠিক চ্যানেলে
দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, ধৈর্যসহকারে আপনাদের কথা শুনতে চাই। তবে সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করলে সবারই অসুবিধা। নির্দিষ্ট চ্যানেল মেনে দাবি-দাওয়া পেশ করবেন।
সরকারপ্রধান বলেন, বৃহৎ রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টস শিল্পে কিছু দিন ব্যাপক অস্থিরতা বিরাজ করেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী বেশ কিছু গার্মেন্ট মালিক পালিয়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের বেতন-ভাতা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অনেক কারখানায়ও শ্রমিকরা ন্যায্য বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। শ্রমিকরা দীর্ঘদিনের বঞ্চনার প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসেন। আমরা তাদের কথা শুনেছি। এতে প্রাণ ফিরে পেয়েছে রপ্তানিমুখী এই শিল্পেও। অক্টোবরে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ২১ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে সরকার
অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে বলে দাবি করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২০ দেশের রাষ্ট্রদূত দিল্লিতে থাকেন। সাত দেশের সাত রাষ্ট্রদূত ঢাকায় আছেন। সমবেতভাবে বৈঠকের জন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রদূতরা ঢাকায় আসছেন। আগে কখনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব রাষ্ট্রদূত একত্রিত হয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেননি। এবার এ কাজটি করার পেছনে আছে সমর্থন প্রকাশ করা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতা গড়ে তোলা।