ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকটাই স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ফিরেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। প্রতিষ্ঠার ৪৬ বছরে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে দলটি। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর এখন মুক্ত পরিবেশে চলাফেরা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করছেন দলের নেতাকর্মীরা। সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ালেও মামলায় নেতাকর্মীদের অবস্থা নাজেহাল। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করবে এমন প্রত্যাশা তাদের। দলটির শীর্ষ কান্ডারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেও এখনও সরাসরি পাশে পাচ্ছেন না নেতাকর্মীরা।
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করলেও নেতাকর্মীদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখছেন, ভার্চুয়ালি বৈঠকও করছেন। এ পরিস্থিতিতে দলকে সাংগঠনিকভাবে সাজানোসহ ‘চোখ’ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। সে লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি।
৫ আগস্টের পর বিদেশিসহ সব মহলে বিএনপির গুরুত্বও বাড়ছে। এখন জনগণের আস্থা ধরে রাখতে মরিয়া দলটির নেতারা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও অবাধ-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন আদায়ই বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা।
তারা জানান, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪৬ বছর অতিক্রম করেছে বিএনপি। এখন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চেতনায় জনগণকে উজ্জীবিত করতে মনোযোগ দিতে চান। একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কারে সরকারকে সহযোগিতার পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময়ও দেবেন তারা।
এ অবস্থায় বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। ঝাঁকজমকভাবে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের কথা থাকলেও বন্যার কারণে কর্মসূচি সীমিত করা হয়েছে। ১ দিনের কর্মসূচি দিয়েছে দলটি। এসংক্রান্ত টাকা বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হবে। ১৯৭৮ সালের এই দিনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসে দলটির হাল ধরেন। পরিচিতি পান আপসহীন নেত্রী হিসাবে। তার নেতৃত্বে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে বিএনপি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সামনে বড় দল হিসাবে বিএনপিকে নানা ‘কৌশলে’ এগোতে হবে। দলের ভেতর বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে হবে। এছাড়াও দলটির সামনে রয়েছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ। এগুলোর মধ্যে উল্লখযোগ্য হচ্ছে-গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দলের কাউন্সিল, রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ, দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটানো। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বপ্রথম নেতাকর্মীদের মধ্যে আস্থা ও মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। সৎ, যোগ্য, ত্যাগী ও মেধাবী নেতাকর্মীদের খুঁজে নেতৃত্বের আসনে বসাতে হবে। দলমত নির্বিশেষে দেশের বিভিন্ন সেক্টরের জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের পরামর্শ গ্রহণ এবং দলে টেনে গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগাতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের ভুল-ত্রুটি চিহ্নিত করে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, এবার একটু ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হবে। কারণ বিগত প্রায় ১৬ বছরে ধরে যে নির্যাতন করা হয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ওপর হয়েছে কিনা জানা নেই। সুতরাং এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের কাছে একটা নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদ মুক্ত হওয়ার পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসেছে, আশা করছি তারা একটা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে। আমরাও সেখানে সহযোগিতা করছি। আমাদের লক্ষ্য এখানে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করা। সেজন্য আমরা কাজ করব। দলকে আমরা সেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রত্যাবর্তন করা। জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া, নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়া, যারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, যেখানে জবাবদিহি থাকবে। যার মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার, আইনের শাসন ফিরে আসবে। মুক্ত অর্থনীতিতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে। দেশের যে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, সেগুলোকে সঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এক বাণীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, গণতন্ত্রকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনার সময় এসেছে। আইনের শাসন, মতপ্রকাশ, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলেই দেড় যুগব্যাপী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শহিদদের আত্মদান সার্থক হবে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভলগ্নে আমাদের অঙ্গীকার হোক বাংলাদেশকে নিপীড়ন-নির্যাতনসহ সব পৈশাচিকতা মুক্ত একটি সুস্থির-শান্তিময় নাগরিক অধিকার সুরক্ষার দেশ হিসাবে গড়ে তোলা। দেশজুড়ে যেন আর কখনোই গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী ও শিশুদের ওপর পৈশাচিকতা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, টাকা পাচারের মতো ঘৃণ্য বিভীষিকার পুনরাবৃত্তি না হয়। জনগণের অধিকার আদায়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট লাঘব এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা আবারও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাই এখন বিএনপির মূল লক্ষ্য।